কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ হলে করণীয়

১৪ জুন বলিউডের তারকা অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। সাধারণ মানুষের সাদাচোখে দেখলে তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ। প্রকৌশলবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষা আর অভিনয়জীবনে সাফল্য, অর্থ, যশ—সবই ছিল। তারপরও কেন এই আত্মহত্যা।

কেবল সুশান্ত সিং রাজপুত নন, এর আগেও আত্মহত্যা করেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস, যাঁর কমেডি অভিনয় দেখে বহু মানুষের মন ভালো হয়ে যেত। আত্মহত্যা করেছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, যাঁর বই পড়ে সবাই নতুন প্রাণশক্তি ফিরে পায়।

সারা পৃথিবীতে সুশান্তর মতো প্রায় ৬০ হাজার মানুষ প্রতিদিন নানাভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে ২ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার আত্মহত্যা করেই ফেলেন। এই হিসাবে বিশ্বে বছরে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করেন। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন! জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়, আরো-এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে…।’ তাই সাধারণের দৃষ্টিতে যাকে মনে হয় সদা হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল, সামাজিক আর অর্থনৈতিকভাবে সফল বলে মনে হয় হয়তো তাঁদের কারও কারও মনের ভেতরে থাকে সেই বিপন্ন বিস্ময় যা তাঁদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।

কী সেই বিপন্ন বিস্ময়?

কেন মানুষ আত্মহত্যা করে, এ প্রশ্নের উত্তর দার্শনিক, গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে কবি-সাহিত্যিকেরা পর্যন্ত খুঁজে বেড়িয়েছেন। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডার্কহাইম তাঁর বহুল আলোচিত গবেষণায় যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁদের চারটি ভাগে ভাগ করেছেন।

এক. আত্মশ্লাঘায় পূর্ণ ব্যক্তি (ইগোস্টিক), যাঁরা সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে—নিজের সবকিছু নিয়ে অহংবোধে ভোগে।

দুই. পরার্থবাদী (অল্ট্রুস্টিক)—যাঁদের সামাজিক সম্পৃক্ততা খুব বেশি।

তিন. আত্মপরিচয়হীন (এনোমিক), যাঁরা সামাজিক রীতিনীতির ধার ধারে না—যাঁদের নেই কোনো সামাজিক বন্ধন।

চার. অদৃষ্টবাদী (ফ্যাটালিস্টিক), যাঁরা সব সময় অদৃষ্টের ওপর নির্ভর করে এবং খুব কঠোরভাবে সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্ষুব্ধ হয়।

গবেষণায় প্রমাণিত যে মানসিক অসুস্থতা বিশেষ করে বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, আবেগের সমস্যা, মাদকাসক্তি আর সিজোফ্রেনিয়ায় যাঁরা ভুগছেন তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। সুশান্ত সিংয়ের সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে আমরা দেখি তিনি বিষণ্নতা রোগে ভুগছিলেন এবং এর জন্য চিকিৎসাও নিচ্ছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বিগত তিন মাসের লকডাউন আর একাকিত্ব তাঁর মধ্যে হয়তো আরও বেশি মানসিক চাপ তৈরি করেছিল।

যাঁরা খুব বেশি কাজপাগল, সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, তাঁদের মানসিক চাপও বেশি। অনেক সময় তাঁরা একধরনের পাফরম্যান্স অ্যাংজাইটিতে ভোগেন। নিজেকে বারবার অতিক্রম করতে চান। মনের ওপর চাপ আরও বাড়ে। পাশাপাশি তাঁদের পেশাগত ব্যস্ততার জন্য পরিবারের সঙ্গে গুণগত সময় কাটানো অনেক সময় হয়ে ওঠে না। কেউ যদি তারকা হয়ে যান তখন সামাজিকভাবে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। খুব ক্ষুদ্র গণ্ডিতে তাদের জীবনটা আটকে যায়। পর্দায় বা মঞ্চে লাখো দর্শক বা ভক্ত তাঁদের দেখে বইকি কিন্তু বাস্তবজীবনে তাঁরা হয়ে যান একটি নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো। এই নিঃসঙ্গতা তাঁদের বিষণ্নতা বাড়ায়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সামাজিকভাবে সফল ব্যক্তি বা তারকারা সামাজিক ট্যাবুর কারণে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য পেশাদার কারও কাছে যেতে কখনো কখনো দ্বিধাবোধ করেন। ফলে তাঁদের মানসিক সমস্যাগুলো চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় থাকে, যা তাঁদের আত্মহত্যার দিকেও ঠেলে দেয়। কখনো গণমাধ্যমে তারকার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সত্য-মিথ্যা নানা সংবাদ বা গুজব প্রকাশিত হলে সেটাও তাঁদের মনের ওপর চাপ বাড়ায়। তারকাদের আত্মহত্যা দেখে তাদের ভক্তরাও কিন্তু অনেক সময় ‘কপিক্যাট’ চেষ্টা চালাতে পারে। যা ভয়ংকর।

করণীয় কী?

• কারও মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ (সব সময় মৃত্যুর কথা বলা, মৃত্যুচিন্তা করা, সরাসরি বা ঘুরিয়ে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কথা বলা, সব বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যুর ইচ্ছা ব্যক্ত করা, সব সময় মন খারাপ থাকা) দেখা গেলে সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
• সব সময় বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ‘আরে ধুর’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
• তাঁর মনের কথা সহমর্মিতা দিয়ে শুনতে হবে।
• মানসিক রোগ নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে হবে। সংস্কার ভেঙে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলতে হবে। সাহায্য নিতে হবে।
• সফল ব্যক্তি বা তারকাদের নিজের মনের যত্ন নিতে হবে। পেশাজীবন গড়ার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে তাঁরা যেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে না যান। নানাভাবে তাঁদের সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের গুণগত সময় দিতে হবে।
• তারকাদের জীবন নিয়ে এমন কোনো গসিপ প্রকাশ করা যাবে না, যা তাঁদের মনের ওপর চাপ তৈরি করে। সংবাদ পরিবশেনে দায়িত্বশীল হতে হবে।
• আত্মহত্যার কৌশল ও মাধ্যম নিয়ে ফলাও করে পত্রিকায় বা টিভিতে সংবাদ প্রচার হলে, আত্মহত্যাকারীকে মহিমান্বিত করা হলে বা তারকাদের আত্মহত্যার সংবাদ দায়িত্বশীলভাবে প্রকাশ করা না হলে পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। আত্মহত্যার সংবাদ গণমাধ্যমে কীভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত হবে, সে বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একটি নীতিমালা রয়েছে, যা সব প্রচারমাধ্যমের জন্য মেনে চলা প্রয়োজন।
• প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মানসিক সমস্যা বা নেশার সমস্যা থাকলে লুকিয়ে না রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।
• সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বন্ধুর এ ধরনের পোস্ট দেখা গেলে তৎক্ষণাৎ তাঁর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে হবে বা ফোনে কথা বলতে হবে। তাঁকে একা রাখা চলবে না।

লেখকঃ আহমেদ হেলাল
সূত্রঃ প্রথম আলো

Comments

  1. Pingback: click site
  2. Rastrear telefone says:

    Monitore o celular de qualquer lugar e veja o que está acontecendo no telefone de destino. Você será capaz de monitorar e armazenar registros de chamadas, mensagens, atividades sociais, imagens, vídeos, whatsapp e muito mais. Monitoramento em tempo real de telefones, nenhum conhecimento técnico é necessário, nenhuma raiz é necessária.

  3. Rastrear Celular says:

    Rastreador de celular – Aplicativo de rastreamento oculto que registra localização, SMS, áudio de chamadas, WhatsApp, Facebook, foto, câmera, atividade de internet. Melhor para controle dos pais e monitoramento de funcionários. Rastrear Telefone Celular Grátis – Programa de Monitoramento Online. https://www.xtmove.com/pt/

  4. Pingback: url
  5. modafinil met of zonder recept in Nederland says:

    I believe everything published made a bunch of sense.
    However, think on this, what if you wrote a catchier title?

    I mean, I don’t wish to tell you how to run your website, but suppose you added
    something that grabbed a person’s attention? I mean আত্মহত্যাপ্রবণ হলে করণীয় is kinda vanilla.
    You could peek at Yahoo’s home page and see how they create news headlines to get people
    to open the links. You might add a related video or a related pic or two to get
    readers excited about what you’ve got to say. In my opinion, it might make your posts
    a little livelier.

  6. venta libre de sibutramine en España says:

    I do not know if it’s just me or if everyone
    else encountering issues with your website. It appears as though some
    of the text in your posts are running off the screen. Can somebody else please comment and let me know if this is happening to them as well?
    This may be a problem with my browser because I’ve had this
    happen before. Many thanks

  7. zoroxin 400 mg a precio asequible en Santiago says:

    Have you ever considered publishing an e-book or guest authoring
    on other blogs? I have a blog centered on the same ideas you discuss and would love
    to have you share some stories/information. I know my viewers
    would appreciate your work. If you’re even remotely interested,
    feel free to send me an e mail.

  8. prijzen van claritin 10 mg in Marokko says:

    Hiya! Quick question that’s completely off topic. Do you know how
    to make your site mobile friendly? My web site looks weird when viewing from my
    iphone. I’m trying to find a template or plugin that might be able to fix
    this problem. If you have any suggestions,
    please share. Thank you!

  9. compra etoricoxib 90 en Perú says:

    Do you mind if I quote a couple of your posts as long as I provide credit and sources back to your website?
    My blog is in the exact same area of interest as yours and my users would truly benefit from a lot
    of the information you provide here. Please let me know if this ok with you.

    Thanks!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *